ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের আগেই কারাবরণ করেন ও পরে এক বোমা হামলায় গুরুতর আহত হন। ১৯৮৯ সালে সর্বোচ্চ নেতার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে তিনি ইরানের ইসলামি শাসনব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে অটল থেকেছেন এবং পশ্চিমা শক্তির প্রতি গভীর অবিশ্বাস প্রকাশ করে আসছেন।
মধ্যপ্রাচ্যের বিশেষজ্ঞ অ্যালেক্স ভাটাঙ্কা বলেন, খামেনিকে দুটি শব্দে ব্যাখ্যা করা যায়। তা হলো তিনি চরমভাবে জেদি, কিন্তু একই সঙ্গে খুব সতর্ক। এই সতর্কতাই তাকে এত বছর টিকিয়ে রেখেছে। তিনি বলেন, খামেনি সব সিদ্ধান্তে মূল লক্ষ্য রাখেন একটি বিষয়ের দিকে তা হলো শাসনব্যবস্থার টিকে থাকা।
ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি সম্পর্কে মঙ্গলবার (১৭ জুন) মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘ট্রুথ সোশ্যালে’ এক পোস্টে বলেন, ‘আমরা জানি, খামেনি কোথায় লুকিয়ে আছেন। তিনি একটি সহজ লক্ষ্য, তবে তিনি সেখানে নিরাপদ। আমরা অন্তত এখনই তাকে হত্যা করতে যাচ্ছি না।’
এই বক্তব্যের পর থেকেই ৮৬ বছর বয়সি খামেনির মৃত্যু নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে।
সাম্প্রতিক ইসরাইলি বিমান হামলায় খামেনি তার বেশ কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সামরিক ও গোয়েন্দা উপদেষ্টাকে হারিয়েছেন। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন ইরানের বিপ্লবী গার্ডের কমান্ডার-ইন-চিফ হোসেইন সালামি, দেশের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির প্রধান আমির আলী হাজিজাদেহ এবং গোয়েন্দা প্রধান মোহাম্মদ কাজেমি। এই ব্যক্তিরা কেবল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাই ছিলেন না, খামেনির উপদেষ্টা মহলের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্বও ছিলেন।
শীর্ষ নেতাদের মৃত্যু ইরানের নেতৃত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে এবং পরবর্তীতে শাসনব্যবস্থার কী হতে পারে তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। আপাতত, খামেনি ক্ষমতায় রয়েছেন। যুদ্ধ থেকে শুরু করে বিচার বিভাগীয় নিয়োগ পর্যন্ত ইরানের সকল গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তিনিই নিয়ে থাকেন। আক্রমণের মুখে পড়ার পর যদি অকল্পনীয় কিছু ঘটে, তাহলে তার উত্তরসূরি কে হতে পারেন এমন শীর্ষ পর্যায়ের একটি তালিকা করেছে দ্য ইকোনোমিক টাইমস ও ইন্ডিয়া টুডে।
মোজতবা খামেনি
সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির ৫৫ বছর বয়সী ছেলে মোজতাবা একজন মধ্যম স্তরের ধর্মযাজক যিনি মূলত জনসাধারণের দৃষ্টির বাইরে থেকেই কাজ করেন । নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক বিষয় সমন্বয়ের ক্ষেত্রে তিনি পর্দার অন্তরালে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন বলে মনে করা হয় এবং বিশেষ করে তিনি বিপ্লবী গার্ডের ঘনিষ্ঠ।অনেক পর্যবেক্ষক বিশ্বাস করেন যে খামেনি নীরবে তাকে উত্তরাধিকারের জন্য প্রস্তুত করছেন। তবে, ক্ষমতার একটি বংশীয় হস্তান্তর ইরানের মতো রক্ষণশীল প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে পারে।
আলিরেজা আরাফি
আলিরেজা আরাফি খামেনির একজন অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য সহযোগী। আরাফি গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে রয়েছেন। যেমন- বিশেষজ্ঞরা পরিষদের উপ-সভাপতি, গার্ডিয়ান কাউন্সিলের সদস্য, এবং কুম শহরের শুক্রবারের নামাজের নেতা। তার ইরানের ক্ষমতার কাঠামোর প্রতি গভীর জ্ঞান এবং বোঝাপড়া রয়েছে তার।
আলী আসগর হেজাজি
সর্বোচ্চ নেতার কার্যালয়ে রাজনৈতিক-নিরাপত্তা বিষয়ক উপ-পরিচালক হিসেবে পরিচিত হেজাজির পর্দার আড়ালে বিশাল প্রভাব রয়েছে। রয়টার্স তাকে দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী গোয়েন্দা কর্মকর্তা হিসেবে বর্ণনা করেছে। তিনি নিরাপত্তা কার্যক্রম সরাসরি তত্ত্বাবধান করে থাকেন। গার্ড ও ধর্মীয় এলিট উভয়ের সঙ্গেই তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তিনি একজন ধর্মীয় নেতা নন, তবে খামেনির সঙ্গে তার সান্নিধ্য তাকে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।
মোহাম্মদ গোলপায়েগানি
মোহাম্মদ গোলপায়েগানি খামেনির অফিসের দীর্ঘদিনের প্রধান কর্মী এবং তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহযোগীদের একজন। তিনি অনুগত এবং গোপনে থাকার জন্য পরিচিত। জনসাধারণের কাছে সুপরিচিত না হলেও, সিস্টেম কীভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে তার গভীর জ্ঞান এবং পর্দার আড়ালে তার কেন্দ্রীয় ভূমিকা তাকে পরবর্তী নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য প্রার্থী বা মূল খেলোয়াড় করে তুলেছে।
আলী আকবর বেলায়াতি
আলী আকবর বেলায়াতি, একজন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং খামেনির পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রবীণ উপদেষ্টা। ধর্মীয় জ্ঞানের সঙ্গে বছরের পর বছর ধরে সরকারি অভিজ্ঞতার মিশ্রণ তাকে পুষ্ট করেছে। তিনি এক্সপিডিয়েন্সি কাউন্সিলে বসেন এবং ইরানের আঞ্চলিক জোটগুলোকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেন। যদিও তিনি বিশ্বস্ত এবং শ্রদ্ধার পাত্র তবে তার বার্ধক্য এবং দুর্বল স্বাস্থ্য তার বিরুদ্ধে যেতে পারে।
কামাল খারাজী
সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল খারাজি এখন ইরানের বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক কৌশলগত কাউন্সিলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি কট্টরপন্থীদের তুলনায় বেশি মধ্যপন্থী বলে মনে হলেও সর্বদা শাসকগোষ্ঠীর সীমার মধ্যে থেকেছেন। ইংরেজিতে সাবলীল এবং জাতিসংঘে অভিজ্ঞ, খারাজী পারমাণবিক চুক্তির পর ইরানের কূটনীতি গঠনে সহায়তা করেছিলেন। সরকারের কেউ কেউ তাকে একজন দক্ষ, প্রযুক্তিবিদ হিসেবে দেখেন।
আলী লারিজানি
ইরানের পার্লামেন্টের সাবেক স্পিকার এবং রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যমের সাবেক প্রধান আলী লারিজানি কোমের এক সুপরিচিত ধর্মীয় পরিবারের সন্তান। বাস্তবমুখী দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী একজন রক্ষণশীল ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি খামেনি এবং নিরাপত্তা বাহিনীর ঘনিষ্ঠ, তবে কিছুটা স্বাধীনচেতা হিসেবেও দেখা হয় তাকে। তার অভিজ্ঞতা এবং শাসনব্যবস্থার প্রতি আনুগত্য তাকে সম্ভাব্য প্রার্থী করে তোলে।
বিশেষজ্ঞ পরিষদ
ইরানের সংবিধান বিশেষজ্ঞ পরিষদকে উত্তরাধিকারের ক্ষমতা দেয়, যা প্রতি আট বছর অন্তর নির্বাচিত সিনিয়র ধর্মগুরুদের নিয়ে গঠিত ৮৮ সদস্যের একটি সংস্থা। এই দলটি গোপনে আলোচনা চালাতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে এবং এমনকি একক সর্বোচ্চ নেতার পরিবর্তে একটি নেতৃত্ব পরিষদও নিয়োগ করতে পারে।
Leave a Reply