ভারতীয় মুসলিমদের অবৈধভাবে বাংলাদেশে নির্বাসিত করার অভিযোগ উঠেছে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে। এদিকে মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোর বলছে, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ভারতজুড়ে হাজার হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ, যাদের বেশিরভাগই বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অবৈধ অভিবাসী বলে সন্দেহ করছে নয়াদিল্লি। তাদের অনেককে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া থেকে বঞ্চিত করে সীমান্ত পার করে প্রতিবেশী মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আইনজীবী এবং নির্বাসিতদের বিবরণ অনুসারে, অবৈধভাবে নির্বাসিত করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে- এমন ব্যক্তিদের মধ্যে ভারতীয় নাগরিকরাও রয়েছেন। বেশ কয়েকটি বিবরণ অনুসারে, যারা ‘পুশ ইন’ করার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিলো তাদের ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বন্দুকের মুখে হুমকি দিয়েছিলো। এরপর থেকে প্রায় ২০০ জনকে বাংলাদেশি সীমান্তরক্ষীরা ভারতীয় নাগরিক হিসেবে শনাক্ত করার পর ভারতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। এদের মধ্যে কিছু লোককে বাড়ি ফেরার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ভূখণ্ড দিয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে যেতে বাধ্য করা হয়েছে।
বাংলাদেশ মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের সিনিয়র গবেষক তাসকিন ফাহমিনা বলেন, আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করার পরিবর্তে, ভারত মূলত মুসলিম এবং নিম্নআয়ের সম্প্রদায়কে তাদের নিজস্ব দেশ থেকে কোনো সম্মতি ছাড়াই বাংলাদেশে ঠেলে দিচ্ছে। ভারতের এই চাপ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখে অনুরোধ করেছিল যে, তারা যেন সরকারি পদ্ধতি অনুসারে পরামর্শ এবং যাচাই-বাছাই ছাড়াই সীমান্ত দিয়ে ‘পুশ ইন’ বন্ধ করে। কিন্তু নয়াদিল্লি সেই চিঠিগুলোর কোনো উত্তর দেয়নি বলে জানানো হয়েছে।
ভারত থেকে যাদের বিতাড়িত করে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে, তাদের মধ্যে আছেন ৬২ বছর বয়সী হাজেরা খাতুন। তিনি শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী একজন বয়স্ক নারী। তার মেয়ে জোরিনা বেগম বলেন, তাদের কাছে প্রমাণ করার জন্য নথি রয়েছে যে, তার মায়ের পরিবারের দুই প্রজন্ম ভারতে জন্মগ্রহণ করেছে। জোরিনা প্রশ্ন করেন, ‘তিনি কীভাবে বাংলাদেশি হতে পারেন?’
২৫ মে পুলিশ হাজেরা খাতুনকে তুলে নিয়ে যায় এবং পরের দিন ১৪ জন মুসলিমের সাথে তাকে একটি ভ্যানে তুলে দেয়। তাদেরকে মাঝরাতে বাংলাদেশ সীমান্তে নিয়ে যাওয়া হয়। হাজেরা খাতুন বলেন, ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) তাদের সীমান্ত পার হতে বাধ্য করে। হাজেরা বলেন, তারা আমাদের সাথে পশুর মতো আচরণ করেছিল। আমরা প্রতিবাদ করেছিলাম যে, আমরা ভারতীয়, কেন আমরা বাংলাদেশে প্রবেশ করব? কিন্তু তারা আমাদের বন্দুক দেখিয়ে হুমকি দিয়েছিল, ‘যদি তোমরা না যাও, তাহলে আমরা তোমাদের গুলি করব।’
হাজেরা উল্লেখ করেন, ‘ভারতীয় দিক থেকে চারটি গুলির শব্দ শোনার পর আমরা খুব ভয় পেয়েছিলাম এবং দ্রুত সীমান্ত পার হয়ে হেঁটে চলে গিয়েছিলাম।’ বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীরা এই দলটিকে আটক করে মাঠের একটি অস্থায়ী শিবিরে রাখে। হাজেরা জানান, বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ তাদের দলটিকে থাকতে দেবে না, কারণ নথিপত্রে দেখা গেছে, তারা ভারতীয় নাগরিক। এরপর তাদের একটি ট্রাকে করে সীমান্তে নিয়ে যাওয়া হয় এবং হেঁটে ভারতে যেতে বলা হয়।
হাজেরা খাতুন বলেন, আমরা যখন ফিরে আসি, তখন পরিস্থিতি ভয়াবহ ছিল। আমাদের বন এবং নদীর মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতে হয়েছিল … আমরা এত ভয় পেয়েছিলাম যে, ভেবেছিলাম যদি বিএসএফ অফিসাররা আমাদের ফিরে আসতে দেখে, তাহলে তারা আমাদের মেরে ফেলবে। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে আমরা মারা যাব।’
অবশেষে ৩১ মে তিনি তার গ্রামে (ভারতের মধ্যে) ফিরে যান। তার পরিবারের মতে, তার আঘাতের চিহ্ন রয়েছে এবং গভীরভাবে আহত ছিলেন। এপ্রিল মাসে ভারত-শাসিত কাশ্মীরে সশস্ত্র হামলায় ২৫ জন পর্যটক এবং একজন গাইড নিহত হওয়ার পর, তথাকথিত ‘অবৈধ বাংলাদেশিদের’ বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপি সরকারের ক্রমবর্ধমান দমন-পীড়ন শুরু হয়। মূলত এরপর থেকে বিজেপি সরকার ‘বহিরাগতদের’ বহিষ্কারের কথা বলে।
উল্লেখ্য, গত মে মাসে অপারেশন সিন্দুর শুরু হওয়ার পর ধড়পাকড় ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। ১১ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে তাদের হিন্দু জাতীয়তাবাদী এজেন্ডার অংশ হিসেবে দেশের মুসলিম জনসংখ্যাকে নির্যাতন, হয়রানি এবং ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করার অভিযোগ রয়েছে। যদিও বিজেপি সরকার এই অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে।
Leave a Reply